ন্যাভিগেশন মেনু

৭ মার্চ ভাষণই বঙ্গবন্ধু’র স্বাধীনতার ঘোষণা


একজন মহান নেতার জন্মগ্রহণের কারণে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তাঁর আগমন না ঘটলো বাঙালি স্বাধীনতার স্বাদ পেত না। বিশ্বে বাঙালি হিসেবে পরিচিতি পেত না। আজ বিশ্বে আমরা বাঙালি জাতি সুপরিচিতি পেয়েছি। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি।  

সবারই জানা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আসে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ।  স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীণ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিকাল৩.২০ মিনিটে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী ঐতিহাসিক ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সম্ভারে তালিকাভুক্ত করেছে। ইউনেস্কো ৭ মার্চ  স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে, গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম,জাতিভেদ-বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী- সবার জন্যই এ ভাষণে অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।

আমাদের স্বাধীনতার জন্য বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বর্বর সামরিক জান্তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির অসহ্য নির্যাতন সইতে হয়েছে। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে পাকিস্তানের কারাগারে।

তবে বাঙালির এ স্বাধীনতা সহজে অর্জিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতিকে ২১ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সাল অবধি বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তীতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিকনির্দেশনায় বাঙালি জাতিকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছে দেয়।

বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন পাকিস্তান আমাদের ওপর শোষণ-শাসন চালিয়ে যাবে। বাঙালি হিসেবে আমাদের দাঁড়াতে দেবে না। তাদের শোষণের যাতাকলে রেখে দেবে। দারিদ্রতা আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়েই থাকবে।

বঙ্গবন্ধু এটা বুঝতে পেরে ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতার সোপান হিসেবে ৬ দফা ঘোষণা করে। পাকিস্তান বিপদ আঁচ করতে পেরে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযোগ দাঁড় করায়। পোরা হয় সামরিক কারাগারে।

অর্থাৎ দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো। কিছুদিন লোক দেখানো বিচারও চলে। কিন্তু বাঙালি বসে থাকেনি। পাকিস্তানের শয়তানি বুঁঝতে পেরে দুর্বার গণআন্দোলন শুরু করে। বাধ্য হয়েই সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

এরপরেই আসে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। সামরিক জান্তা শর্ত জুড়ে দেয় ছয় মাসের মধ্যে একটা সংবিধান তৈরি করতে হবে সাংসদদের। এটা করতে ব্যর্থ হলে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে জারি করা সামরিক শাসন।

সামরিক জান্তা ভেবেছিল- বিভিন্ন দলের সাংসদগণ সংবিধান তৈরি নিয়ে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়বে। সংবিধান আর রচনা করা হবে না। সামরিক জান্তার শাসনের পথ সুগম হবে।

কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে ১৫৮ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠনের ব্যাপারে তালবাহনা শুরু করে।

আলোচনার নামে পথ খুঁজতে থাকে কী করে বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দেওয়ার। আর অস্ত্রের ভাষায় বাঙালিকে দমিয়ে রাখার। বঙ্গবন্ধু তা বুঁঝতে পেরে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। তিনি বুঁঝতে পেরেছিলেন সামরিক জান্তা তাঁকে কারাগারে পাঠবে।   

জাতির পিতা তাঁর অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ৭ মার্চ ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্খাকে একসূত্রে গেঁথে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

আগেই বলেছি- ৭ মার্চ ছিল মূলত: স্বাধীনতার ডাক।  ৭ মার্চের ভাষণের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। কোনো ধরণের আপোসের পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষজীবন উৎসর্গ করে।

এটা বিশ্ব ইতিহাসে নজীরবিহীন। শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্ববোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে ¯পষ্ট দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি। 

এ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় আবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী। এ ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- এর কাব্যিক গুণ-শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস।

যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও  চতুর্দিকে অনুরণিত। যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই উত্থিত হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তা তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত বলা যায়।

তদুপরি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি আকারে ছিল নাতিদীর্ঘ ও অলিখিত। ১৮৬৩ সালে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন-এর ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত যা ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়।

আফ্রো-আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণটির প্রথমাংশ লিখিত ও পঠিত যার শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ।

আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল ১৮ মিনিটব্যাপী, শব্দ সংখ্যা ১১৩৫।  যেটি ছিল তাৎক্ষণিক, স্বতস্ফুর্তও অলিখিত। এ ভাষণের প্রতিটি শব্দ নির্বাচন করা হয়েছিল অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনের নিরিখে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল তার হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথিবীর বহুসমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক  বহুমাত্রিক বিশ্লেষণকরেছেন।এ ভাষণ বিশ্বসম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল।

লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার তখনকার বিখ্যাত কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিল ডান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নেতা এলেন, যিনি, চারিত্রিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষা, পোশাক-আশাক, গায়ের রং, আচার আচরণে একজন নিখুঁত বাঙালি।

তাঁর বজ্রকন্ঠের ঘোষণা দেশের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে এবং মান্য করে। ১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, “বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির পথ প্রদর্শক। তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবী স্বীকার করবে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেন, “৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।”

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, “৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।”

গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস।

অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল ৭ মার্চের  ঐতিহাসিক ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণ একটি জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী এক মহাকাব্য। এ ভাষণে তাঁর তেজস্বিতা ও সম্মোহনী ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে।

এ ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। এ ভাষণমানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলে। এভা ষণ ছিল বহুমাত্রিকতায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল।

১৮ মিনিট ব্যাপ্তি এ ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আপামর বাঙালি জাতি। এ ভাষণের জন্যেই বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ খেতাবে আখ্যায়িত করা হয়। ২০১৭ সালের  ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এ ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সাতই মার্চের ঐতিহাসিক এই ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে প্রচার করার কথা ছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে সেদিন রেডিওতে তা প্রচার করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু সেদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বক্তব্য রাখতে পারেন, এ আশায় রেসকোর্সের ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল।

সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের এমএনএ ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এম আবুল খায়ের এমএনএ ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাঁচ আসনের (বর্তমান গোপালগঞ্জ- ১ আসন) নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তাদের এ কাজে সাহায্য করেন অভিনেতা আবুল খায়ের।

আর এ কারণেই সাতই মার্চের ১০ মিনিটের একটি ভিডিও চিত্র আমরা দেখে থাকি। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বেতার কর্মীরা সরাসরি ভাষণটি প্রচার করতে না পারলেও  রেকর্ডটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। যা পরদিন বাঙালি বেতারকর্মী ও আপামর জনতার দাবির প্রেক্ষিতে বেতারে প্রচার করা হয়।

ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা মঞ্চের নিচে লুকিয়ে ঐ ভাষণের অডিও-ভিডিও ধারণ করেছিলেন। 

যুদ্ধ চলাকালীন সময় এর কয়েকটি রেকর্ড কপি ভারতে পাঠানো হয়, সেখান থেকে বিশ্বখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি এইচএমভির উদ্যোগে এ ভাষণের তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়।’

লেখক: আজকের বাংলাদেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক

[email protected]