ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১১তম দিন:

চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়নের পূর্ববাংলা কায়েমের আহ্বান


১১ মার্চ ১৯৭১। এদিনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ি সরকারের সাথে সবধরনের অসহযোগিতা অব্যাহত রাখেন স্বাধীন বাংলার দাবিতে অবিচল সর্বস্তরের মানুষ। অসহযোগ আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অফিস বর্জন করেন। বাংলার সর্বত্র ওড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা। সিনেমাহলগুলোতে বাংলাদেশের নতুন পতাকা প্রদর্শন এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাজানো অব্যাহত থাকে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জননেতা তাজউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানান। অসহযোগ আন্দোলনের নেতা-কর্মী সমর্থকদের তিনি অভিনন্দন জানান। 

অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বিশ্ববাসীর সমর্থন চান। গণআন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের একদিনের বেতন আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

গণহত্যার প্রতিবাদে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর পাকিস্তান সরকারের এক চিত্রপ্রদর্শনীতে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। এসময় তিনি দেশের অন্য চিত্রশিল্পীদেরও যোগদানে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

১১ মার্চ ন্যাপ (ওয়ালী) পূর্ববাংলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম. খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে. উলফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন।

এই দিনে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে নির্ধারিত সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পাকিস্তান সরকার বাতিল ঘোষণা করে।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে ৩২ হাজার টন গম নিয়ে ‘ভিনটেজ হরাইজন’ নামক একটি মার্কিন জাহাজ গতি ঘুরিয়ে পাকিস্তানের করাচিতে পাঠিয়ে দেওয়ায় সারাদেশের মানুষ উৎকণ্ঠা ও নিন্দা জানায়।

এদিকে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বিকেল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে পথসভা ও খণ্ড মিছিল বের হয় এবং স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আরও দুর্বার করে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করা হয়।

জনগণের প্রতি ছাত্র ইউনিয়নের স্বাধীন পূর্ববাংলা কায়েম করার সংগ্রামের যে আহ্বান ছিল তা হলো:

১) রাজনৈতিক প্রচার অব্যাহত রাখুন। গ্রাম অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে ইহা ছড়াইয়া দিন।

২) সর্বত্র ‘সংগ্রাম কমিটি’ ও ‘গণবাহিনী’ গড়িয়া তুলুন।

৩) শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকুন।

৪) যে কোনো রূপ দাঙ্গা-হাঙ্গামা-উস্কানি প্রতিরোধ করুন।

৫) শান্তি-শৃঙ্খলা নিজ উদ্যোগে বজায় রাখুন।

৬) এই সংগ্রামের সফলতার জন্য সব গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শক্তির ঐক্য গঠনের জোর আওয়াজ তুলুন।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানি ব্যাংক কর্মকর্তাদের টাকা পাচার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।

এদিন চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ নেওয়ার কথা থাকলেও বিচারপতি বি.এ.সিদ্দিকী শপথ বাক্য পাঠ না করানোয় চট্টগ্রামে আনন্দমিছিল করা হয়। একটি আনন্দমিছিল দেওয়ানহাট হয়ে হালিশহরের দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ বিহারীরা তলোয়ার আর বন্দুক নিয়ে মিছিলে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর হামলা চালায়। এতে পনেরো থেকে বিশজন বাঙালি নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার খবর আসে। পরে কিছু বাঙালি যুবক টাইগারপাসে দুই বিহারীকে গুলি করে। এই ঘটনার পর সন্ধ্যায় পাকিস্তান আর্মি সারা শহরে টহল দেয়। থমথমে হয়ে যায় পুরো শহর। আর্মির গাড়িতে বিহারী জল্লাদরাও ছিল। পরে আগ্রাবাদ মোড় থেকে পাঁচ-ছয়জন বাঙালি যুবককে তুলে নেওয়ার খবর পাওয়া যায়, যাদের পরবর্তীতে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এদিন কুমিল্লা কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় তিন কয়েদী। অন্যদিকে বরিশাল কারাগার ভেঙে ২৪ কয়েদী পালিয়ে যায় এবং এ সময় ২ কয়েদী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলিতে প্রতিদিনই বাড়তে থাকে শহীদদের তালিকা। একেকটি মৃত্যু বাঙালির রক্তে প্রতিশোধের স্পৃহা আরও বেড়ে যায়।

জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রেরিত এক তারবার্তায় বাংলার শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্যে তার “প্রাণ কাঁদিতেছে” উল্লেখ করে বলেন যে পাকিস্তান রক্ষা ও শান্তি স্থাপনের জন্যে তাদের দুজনের উপর যে দায়িত্ব রয়েছে তা সাধ্যমত পালনের লক্ষ্যে তিনি ঢাকায় শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় বসতেও রাজি আছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট বাংলাদেশে অবস্থানকারী জাতিসংঘের সকল কর্মচারীকে নিউইয়র্কে ফিরে আসার নির্দেশ দিলে বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হন এবং উথন্ট-এর কাছে প্রশ্ন তোলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের কী হবে?

ঢাকাস্থ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে শেখ মুজিব তার কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সমরসজ্জায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

পাকিস্তানিরা গোপনে সামরিক শক্তি ও অস্ত্র গোলাবারুদ মজুদ করতে থাকে। 

স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা দুটি বিবৃতিতে বলেন - ১০ মার্চ ভোরে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘এম.এন সোয়াত’ নামে একটি অস্ত্রবাহী জাহাজ থেকে শ্রমিকরা সমরাস্ত্র খালাস করতে অস্বীকার করায় পরে সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই তা খালাস করে এবং এরমধ্যে একজন বাঙালি সেনা অফিসারও ছিল।

এদিন জানা যায়, আরও পাঁচটি অস্ত্র ও সৈন্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা হবে। সামনে কী ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে- স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি- ঠিকই তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিপুল প্রস্তুতির তীব্র প্রতিবাদ জানান।

তাজউদ্দীন আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেন, জনগণের অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে পৌঁছেছে। জনগণের এই আন্দোলন সফল করতে অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত সবাইকে কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি কিছু নির্দেশনাও দেন।

আসগর খান করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য আর মাত্র কয়েকটি দিন হাতে রয়েছে এবং ঢাকায় যদি সৈন্যরা আর একটি গুলি চালায় তাহলে পাকিস্তান শেষ হয়ে যাবে।

সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণীর বাঙালী কর্মচারীরা অসহযোগ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

[তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ, ১০ মার্চ ১৯৭১]

এডিবি/