ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ৯ম দিন:

মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন


৯ মার্চ ১৯৭১। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিল নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা। ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মিছিলে মিছিল উত্তাল ঢাকার রাজপথ।

সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ এর ছাত্রসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

বিকেলে উত্তাল ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার চিরাচরিত দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘হে বাঙালিরা, আপনারা মুজিবের উপর বিশ্বাস রাখেন, তাকে খামোকা কেউ অবিশ্বাস করবেন না, কারণ মুজিবকে আমি ভালোভাবে চিনি।’

তার একথা শুনে উপস্থিত জনতার করতালি আশপাশ প্রকম্পিত করে তুলে।

তিনি বললেন, ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে গেলে ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে।’ 

মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়, তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। “লা-কুম দিনিকুম অলিয়া দ্বীন” অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার; পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।’

জনসভায় মজলুম জননেতা আরও বলেন, ‘মুজিবের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবো।’

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এখানে পৃথক ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর।’

আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ি সচিবালয়-সহ সারাদেশে সকল সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলাকোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কেবল সেসব অফিস খোলা থাকে।

গভীর রাতে ইসলামাবাদে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসক নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। 

টিক্কা খান ৭ মার্চ ঢাকা আসেন। এর আগে ৬ মার্চ তাকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। ৯ মার্চ তার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতাল চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী। তাছাড়া, ঢাকা হাইকোর্টের কোনো বিচারপতি নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান।

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘের উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দপ্তর পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামরিক প্লেন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

৯ মার্চ রাত ৯টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজশাহী শহরে ৮ ঘন্টার জন্য কারফিউ জারি করে সামরিক কর্তৃপক্ষ। নৈশ কারফিউ জারির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।

সকালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বাঙালি কর্মীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এদিন পাকিস্তানীজান্তা নিয়ন্ত্রিত বাংলা সংবাদপত্র ‘দৈনিক পাকিস্তান’ সম্পাদকীয়তে লিখে, “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সংকটমুক্তির একমাত্র পথ”।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পূর্ব পাকিস্তান সফরের ঘোষণা দেওয়া হয় এইদিন।

হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন জোরেশোরে পালনরত চট্টগ্রামবাসীর সাথে অবাঙালীরা রেলওয়ে কলোনী ও এ.কে.খান রোডে দুপুরের দিকে সংঘর্ষে জড়ায়। বিকেলে হালিশহর হতে দেওয়ান হাট হয়ে আগ্রাবাদ পর্যন্ত অবাঙালীরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শোডাউন করে। পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠে। অন্যদিকে, চট্টেশ্বরী রোডে চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদের অফিসে গণসঙ্গীতের মহড়া শুরু হয়।

[তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১ এর বিভিন্ন সংবাদপত্র]

এডিবি/