ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ষষ্ঠ দিন:

স্বাধীনতাকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণায় প্রকম্পিত রাজপথ, অধিবেশন ডাকেন ইয়াহিয়া


১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ছিলো বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভার আগের দিন। এদিন সকাল ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। 

ঢাকার রাজপথ এদিনও স্বাধীনতাকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণায় প্রকম্পিত। বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগ দিতে সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ঢাকার দিকে আসতে থাকেন।

ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে। সশস্ত্র-বাহিনীর ট্রাক আর অ্যাম্বুলেন্স ঘন ঘন যাতায়াত করছিলো। কিন্তু বন্ধ ছিলোনা মুক্তিকামী বাঙালির মিছিল, মিটিং। স্লোগান উঠেছিলো ‘জয় সর্বহারার জয়, জয় বিদ্রোহী বাংলার জয়, জয় নিপীড়িত মানুষের জয়’। একটি স্লোগান সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হতে থাকলো ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তারই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে ইতোপূর্বে বেতন দেওয়া হয়নি সেসব অফিস বেতন দেওয়ার জন্য খোলা থাকে।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন, যতোদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি ততোদিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতিরে নিশ্চয়তা বিধান করবো।

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। পল্টনে হয় অলি আহামদের জনসভা আর মোজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে গণসমাবেশ।

বিকেলে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে নারীরা লাঠিসোঁটা ও কালো পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন। 

একই সময় বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে সাংবাদিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিরাট মশাল মিছিল বের হয়। 

এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), গণশিল্পীগোষ্ঠী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে জনসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তার দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।

লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ-শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তারের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।

পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

১ মার্চের পর থেকে সারা প্রদেশে গুলিবিদ্ধ লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর আর ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৮ জন শহীদ এবং আহত হয়েছিলেন ৮৬ জন। রাজশাহীতে মিছিলের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে একজন নিহত ও ১৪ জন আহত হন। সেখানে ওই দিন সান্ধ্য আইন জারি ছিল।

চট্টগ্রামে আগের দিন বিহারী-বাঙালি শান্তি কমিটি গঠন হবার পরও আজ পাকি আর্মির সহায়তায় বিহারীরা ও পাকিবন্ধু কিছু বাঙালি হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠন করে। লুন্ঠনের সময় স্থানীয় হিন্দু ও পুরোহিতদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এই ঘটনা বিহারী, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সাথে সাধারণ বাঙালিদের সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালে। রেলওয়ে কলোনী, হালিশহর, আগ্রবাদ ও নিউমার্কেট এলাকায় বাঙালি-বিহারীর সংঘর্ষ হয়। আন্দরকিল্লা, ফিরিঙ্গী বাজার, আসাদগঞ্জ, চকবাজারে সাধারণ বাঙালিদের সাথে বিহারী-জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ৬ মার্চ জানান, ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সব ধরনের বিমান চলাচলে এখন থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।

গণ ঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।

এদিন বিকেলে লাহোরে আওয়ামী লীগের পাকিস্তান শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বি এ সলিমী ও পাঞ্জাব প্রদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদ সরফরাজসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শত শত মানুষ নিহত হওয়ার পর, মিছিল, মিটিং, কারফিউ ভঙ্গ, প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের পর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান কি ঘোষণা দেন; তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষ করতে থাকে মুক্তিকামী বাঙালি।

[তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১ এর বিভিন্ন সংবাদপত্র]

এডিবি/