ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১০ম দিন:

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে দেশ, চট্টগ্রামে অস্ত্র খালাসে শ্রমিকদের অস্বীকৃতি


১০ মার্চ ১৯৭১। আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি সারাদেশে পালিত হয়। এদিনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। শুধু বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে।

অনেক বাড়িতে ওড়তে থাকে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা ওড়ে। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়িগুলোও কালো পতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলাচল করে।

সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কর্মীসভায় ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতাদের স্বাক্ষরিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী সরকারকে সহযোগিতা না করার আবেদন জানানো হয়।

তাছাড়া, এই সভায় সরকারের গুম-খুন-হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে তখন পর্যন্ত যেসব বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা ওড়ানো হয়নি, সেখানে কালো পতাকা ওড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।

এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে দেন। বঙ্গবন্ধু এ সময় বলেন, সাতকোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে কোনো মূল্যে তারা এই অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করতে চাই। বাঙালি চায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা কোনো আপস করব না।’

ন্যাপ (ওয়ালী) পূর্ববাংলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম. খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে. উলফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসা-পরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশর জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। সামরিক সজ্জা অব্যাহত রেখে বাংলার বুকে এক জরুরী অবস্থা কায়েম রাখার প্রয়াসী। তারা বাংলাদেশের সর্বত্র এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ভীতসন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করছে।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের জীবন ও সম্পদ কতোটা বিপন্ন করে তুলেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই নির্দেশে তারই স্বীকৃতি মেলে। জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুধাবন করা উচিত, কেবল জাতিসংঘের কর্মীদের অপসারণ করলেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেনোনা, যে হুমকি আজ উদ্যত, সেটি গণহত্যার। সে হুমকি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদে সংরক্ষিত মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর। ধ্বংসকারী যতো অস্ত্রেই সুসজ্জিত থাকুন না কেনো, কোনো শক্তিই আর বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।

বিকেলে ওয়ালীপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীনবাংলার দাবিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন।

১০ মার্চ লেখক-শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিল বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায়। 

অন্যদিনের মতো এদিনও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ও কুচকাওয়াজ করেন। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে মিছিল বের করে।

সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের প্রতিনিধিরা সভায় মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেন। 

চলচ্চিত্র প্রদর্শকেরা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকাল সিনামাহল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

এদিন রাজশাহী শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা নৈশ কারফিউ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

নিউ ইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ছাত্ররা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা বিষয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে মহাসচিব উ থান্টের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন।

করাচীতে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে ন্যাপপ্রধান ওয়ালী খান বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে মতবিনিময়ের জন্য ১৩ মার্চ ঢাকায় আসবেন। ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায়, সে জন্য আগে আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করতে হবে।

এদিন থেকে সংগ্রমী জনতা সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন নেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেওয়া হয়। যশোরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

রাতে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪নং সামরিক আদেশ জারি করে নির্দেশ দেয়, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পতির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্রবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের শামিল বলে গণ্য হবে, যা সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।

১০ মার্চ টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান সাতকোটি বাঙালির নেতা। নেতার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই সাথে হয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয়। জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় ভুট্টো বলেন, উদ্ভুত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমরা আজ বিরাট সঙ্কটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যেকোন মূল্যের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করতে হবেই।

করাচিতে গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, খুব দ্রুত পটপরিবর্তন হচ্ছে। দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে যথা শিঘ্রই ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ প্রদান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন ঢাকার সরকার। সেখানে সব সরকারি কর্মচারী এবং সচিবরা তাঁর নির্দেশ পালন করছেন। ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে।

তিনি আরও বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দু’অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

এদিন পাকিস্তানের সমরাস্ত্র নিয়ে আসা জাহাজ ‘এম এল সোয়াত’ চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে ভিড়ে। জাহাজ থেকে নামিয়ে সমরাস্ত্রগুলো বিভিন্ন সেনাছাউনিতে পাঠানোর জন্য বন্দরের বাইরে ওয়াগন প্রস্তুত রাখা হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা এসব সমরাস্ত্র জাহাজ থেকে নামানোর নির্দেশ মানেনি। পরে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ নামানোর ব্যবস্থা করতে গেলে উপস্থিত জনতা তা প্রতিরোধ করে।

এদিন চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা যে কোনো সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামে বাস্তবায়নের সংকল্প জানায় পরিষদের নেতারা।

[তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ, ১০ মার্চ ১৯৭১]

এডিবি/