ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের অষ্টম দিন:

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে ঢাকা বেতারের সম্প্রচার শুরু, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ-এর নাম পরিবর্তন


বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ৮ মার্চ থেকে শুরু হয় সংগ্রামে নতুন পর্যায়। সারাদেশে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আগের মতোই চলতে থাকে।

এখন থেকে প্রতিদিন সংগ্রামী জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নির্দেশে কাজ করতে থাকে। হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে সাধারণ মানুষের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছিলো বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে।

অন্যদিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান ক্যান্টনমেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

৮ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে সম্প্রচার কাজ শুরু হয়। প্রদেশের অন্যান্য বেতার কেন্দ্র থেকেও তা রিলে করা হয়।

আজকের দিনে 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ'-এর নাম পরিবর্তন করে শুধু 'ছাত্রলীগ' রাখা হয়।.

ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আ. স. ম. আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক সনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন আমরা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষিত নির্দেশের ব্যাখা দেন। এতে বলা হয়, ব্যাংকগুলো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ভেতরে নগদ জমা, বেতন ও মজুরী দেওয়া, এক হাজার টাকা পর্যন্ত উত্তোলন এবং আন্তঃব্যাংক ক্লিয়ারেন্স ও নগদ লেনদেন করতে পারবে। 

তাছাড়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় বিভাগগুলো খোলা থাকবে। সার সরবরাহ ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। পোস্ট অফিস সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে। পানি ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ পৃথক আরেকটি বিবৃতিতে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্রেসনোটের প্রতিবাদ জানান। প্রেসনোট মাত্র ১৭২ জন নিহত, ৩৫৮ জন আহত হয়েছে বলে জানানো হয়। তিনি এক বিবৃতিতে প্রেসনোটকে মিথ্যাচার বলে বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ক্ষেত্রেই গুলিবর্ষণ করা হয়েছে বলে কথিত বক্তব্য সত্যের অপলাপ। নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীদের ওপরই নিশ্চিতভাবে গুলি চালানো হয়েছে। পুলিশ ও ইপিআর গুলিবর্ষণ করেছে বলে যে প্রচারণা করা হয়েছে তা বাঙালিদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।

এইদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলচ্চিত্র শিল্পীরা আন্দোলনের পক্ষে তাদের একাত্বতা প্রকাশ করেন।

বৃটেনে প্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তানি হাই কমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

ইসলামাবাদে পিপলস পার্টির চেয়াম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া শর্ত সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

৮ মার্চ, বাংলা ২৩ ফাল্গুন (সোমবার) তখনকার অন্যতম প্রধান দৈনিক ইত্তেফাক খবরটি ছাপে ৮ কলাম ব্যানারে। শিরোনাম ছিল, ‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি, যদি-’। যদি চারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়। শিরোনামের নিচে উল্লেখ করা হয় সেই চার দাবি - 

ক. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয় 

খ. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় 

গ. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা হয় 

ঘ. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

শিরোনামের নিচে দেওয়া হয় গর্জে ওঠা বঙ্গবন্ধুর ছবি। এই ছবির ক্যাপশনটা ছিল, ‘....সামরিক বাহিনীকে অবিলম্বে ব্যারাকে ফিরাইয়া লও’।

আরেকটি প্রধান দৈনিক সংবাদ-এ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আট কলামজুড়ে ছাপা হয়। রিভার্স টাইপে শিরোনাম ছিল: ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রামঃ মুজিব’। 

খবরটিতে দুই লাইনের শোল্ডার ছিল: ‘সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিলেই পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিব কি না ঠিক করিব’। ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দেন, তা ‘মুজিবের নির্দেশ’ নামে পৃথক আরেকটি শিরোনামে ছাপা হয়। ভেতরে ছাপে ‘শেখ মুজিবের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ’। সংবাদে ‘গতকালের রেসকোর্স ময়দান’ শিরোনামে এক কলাম একটি খবর ছাপা হয়। খবরের প্রথম দুটো অনুচ্ছেদ ছিল এ রকম: ‘গতকাল রেসকোর্স ময়দান ছিল পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণির মুক্তিকামী মানুষের বিচিত্রময় সমাবেশে পূর্ণ।’

[তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১ এর বিভিন্ন সংবাদপত্র]

এডিবি/