২০ মার্চ ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের উনিশতম দিন। এদিন একদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং অন্যদিকে জেনারেল টিক্কা খান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গোপন বৈঠকে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুমোদন দেয়।
২০ মার্চ সকাল ১০টায় কঠোর সামরিক প্রহরায় রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সাথে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ছয়জন শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান।
প্রায় সোয়া দুই ঘন্টা আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের আলোচনা এগিয়ে চলছে, কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নাই। সময় আসলে অবশ্যই আমি বিস্তারিত বলবো।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাব শেখ মুজিব জানান, ‘জয়দেবপুরে নিরস্ত্র জনতার ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি আমার বক্তব্যে বলেছি। প্রেসিডেন্ট ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবেন বলে আমাকে কথা দিয়েছেন।’
এদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাক্তন নৌসেনাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে তারা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
সারাদিন মুক্তিপাগল জনতার দৃপ্ত পদচারণায় ঢাকার রাজপথ টালমাটাল হয়ে ওঠে। মিছিলের পর মিছিল যাচ্ছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে। সেখানে শপথ গ্রহণের শেষে একের পর এক শোভাযাত্রা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবনে গিয়ে সমবেত হয়।
সেখানে সমাগত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত ভাষণদানকালে মুজিব দৃঢ়তার সাথে ঘােষণা করেন, মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোনাে শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশকে কলােনি করে বাজার হিসেবে ব্যবহার করার দিন শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে জনগণ তাদের আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাবেন। তাদের কাছে এই আমার আবেদন। নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধিমূলক ও উস্কানির বিরুদ্ধে আমি হুশিয়ারি উচ্চারণ করছি।
ন্যাপ (ভাসানী) এদিন ২৩ মার্চ “স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস” পালনের প্রস্তুতি হিসেবে মগবাজার, ফার্মগেট, নিউমার্কেট ও খিলগাঁয়ে পথসভা করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাসভবনে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) প্রধান মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।
রাতে এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব বলেন, একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।
এবারের সংগ্রামে প্রতিটি শহর, নগর, বন্দুর ও গ্রামে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের স্বাধীনতা-প্রিয় মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছে। একটি ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়সংকল্প জাতি কিভাবে স্বীয় লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আওয়ামী লীগের নির্দেশের আওতা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কাজে নিরলস পরিশ্রম করার জন্য সর্বস্তরের জনগণ, ক্ষেতের চাষী, কারখানার শ্রমিক, অফিসের কর্মচারী সবাইকে আমি অভিনন্দন জানাই। আওয়ামী লীগের নির্দেশমূহ যথাযথভাবে প্রয়োগ করার জন্য যাঁরা অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করছেন, সেইসব ছাত্র, শ্রমিক এবং কর্মচারী সংগঠনগুলোর সদস্যদের আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমাদের জনগণ প্রমাণ করেছে তাঁরা সুচারুভাবেই তাদের নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। উস্কানির্মূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার জন্য ধ্বংসাত্মক ব্যক্তিদের আমি হুশিয়ার করে দিচ্ছি। জনসাধারণের নিত্যদিনের প্রয়োজন মিটানো অব্যাহত রাখার স্বার্থেই অর্থনৈতিক তৎপরতার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের জনগণকে কঠোর শৃঙ্খলা পালন করতে হবে। [সূত্র: দৈনিক আজাদ, ২১ মার্চ ১৯৭১]
এদিন লাহোর দিবস উপলক্ষে সারা বাংলায় ২৩ মার্চ সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
এ দিনও রাজধানীর সব সরকারি বেসরকারি বাসভবন ও যানবাহনে কালো পতাকা উড়তে থাকে।
প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌসুলী এ.কে.ব্রোহি সকালে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন।
পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তিনি লন্ডন পরিকল্পনা যা ১৯৬৯ সালে লন্ডনে বসে শেখ মুজিব, খান আবদুল ওয়ালী খান ও মিয়া মমতাজ মোহম্মদ খান দৌলতানা কর্তৃক প্রণীত তা মানবেন না। তিনি বলেন ওই পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ প্রধান কর্তৃক ঘোষিত ৬দফার ভিত্তিতেই করা হয়েছে।
এদিন ভুট্টো সাংবাদিকদের কাছে ২১ মার্চ ঢাকা বৈঠকে যোগদানের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন যে তাকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানানাের প্রেক্ষিতে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে যে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন, ঢাকা থেকে সে সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব মেলায় ঢাকা বৈঠকে যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
২০ মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গোপন বৈঠক এবং বৈঠকে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুমোদন করা হয়।
[সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ]
এডিবি/