ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১৩তম দিন:

আওয়ামী লীগের প্রতি জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘু দলগুলোর সমর্থন


১৩ মার্চ, ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত ছিলো। স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খায় আন্দোলন-সংগ্রামে মুখর পূর্ব বাংলার জনপদ। প্রতিটি ঘরে ও ভবনের ছাদে উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা আর কালো পতাকা। চারদিকে চলতে থাকে সভা-সমাবেশ। অসহযোগ আন্দোলনের এক সপ্তাহেই দেশ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। এদিন জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ট দলগুলো আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানায়।

পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সংসদীয় দলগুলো লাহোরে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে আওয়ামী লীগের ৭ মার্চের ভাষণে উত্থাপিত ৪টি দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ২৫ মার্চের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানায়।

জমিয়াতুল উলামা-ই-ইসলামের নেতা মওলানা মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন, মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা এবং সরদার শওকত হায়াত খান, জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তানের মওলানা শাহ আহমদ নূরানি, জামায়েতে ইসলামীর অধ্যাপক আব্দুল গফুর, মুসলীম লীগ (কনভেনশন) এর জামাল মো. কোরেজা এবং স্বতন্ত্র সদস্য মওলানা জাফর আহমদ ও সরদার মওলা বক্স সুমরো। সভায় ন্যাপ (ওয়ালী) দলের কেউ উপস্থিত না থাকলেও তারা এ প্রস্তাব সমর্থন করে। 

কিন্তু মুসলীম লীগ (কাইয়ুম) এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করে।

এই সভায় জমিয়াতুল উলামা-ই-ইসলামের নেতা মওলানা মুফতি মাহমুদ তিনটি আহ্বান জানান।

১) পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার।

২) ২৫ মার্চের আগে ক্ষমতা হস্তান্তর।

৩) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।

১৩ মার্চ পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ১১৫নং সামরিক আদেশ জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১০টার প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। এই সামরিক নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকুরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

এই সামরিক নির্দেশ জারির পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচণ্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি ঠিক তখন নতুন করে এধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উস্কানি দেওয়ার শামিল।

১৩ মার্চ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এক জনসভায় বলেন, “বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন, শ্লোগানের প্রয়োজন নাই”। এদিন তিনি রাজবন্দীদের মুক্ত করার জন্য ‘জেল ভাঙ্গা’ আন্দোলনের ডাক দেন।

এদিন সন্ধ্যায় ছাত্র ইউনিয়ন বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে বিশাল মশাল মিছিল বের করে।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল ফজলের সভানেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মহিলাদের এক সমাবেশে বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাসদ্রব্য বর্জন ও কালোব্যাজ ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

১৩ মার্চে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন।

এদিন ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিম জার্মানির ৬০ জন, জাতিসংঘের ৪৫ জন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সের ৪০ জনসহ মোট ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ প্লেনে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যান।

অন্যদিকে, স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্তবিবৃতিতে বাংলাদেশত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ  কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারের সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানায়।

সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির এক বিবৃতিতে ‘লেটার অব অথরিটি’ দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে পূর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবকটি ব্যাটিলিয়নের পরিচালনা কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে পূর্ববাংলায় যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের প্রত্যাহারের দাবি জানান।

পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্ণর জেনারেল আজম খান এদিন সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন।

ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী ও ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো সকালে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে ন্যাপপ্রধান বলেন, বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার জন্য আমি খোলা মনে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একমত।

[তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ] 

এডিবি/