ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১৯তম দিন:

জয়দেবপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ


১৯ মার্চ ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের আঠারোতম দিন। এইদিনে গাজীপুরের জয়দেবপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ করা হয়। এদিন এই প্রতিরোধ আন্দোলনে চারজন বীর বাঙালি শহীদ হন। তাছাড়া আহত হন শত শত প্রতিবাদী জনতা।

সেদিনও ছিল শুক্রবার। জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এ রেজিমেন্টের ২৫-৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন বাঙালি অফিসার ও সৈনিক।

একদিকে চলছিলো স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা এঁটে যাচ্ছিলো। এ ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিলো বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন করে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা।

পরিকল্পনা মতো ঢাকার ব্রিগেড সদর দপ্তর থেকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নির্দেশ এলো, ১৫ মার্চের মধ্যে রাইফেল গুলিসহ ব্রিগেড সদর দপ্তরে জমা দিতে হবে। কিন্তু বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা অস্ত্র জমা দিতে অনিচ্ছুক। ওই সময় ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার পাকিস্তানী এক ব্রিগেডিয়ার নিজেই ১৯ মার্চ অস্ত্র ও গুলি আনতে জয়দেবপুরের যাওয়ার সময় বর্তমান চান্দনা চৌরাস্তায় হাজার হাজার বাঙালির ব্যারিকেডেের মুখে পড়ে।

এদিনে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তার এক লেখায় যেভাবে দিনটির কথা বর্ণনা করেছেন:

‘৯ মার্চ শুক্রবার আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়দেবপুরস্থ (গাজীপুর) ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। একজন J.C.O  (নায়েব সুবেদার) জয়দেবপুর হাইস্কুলের মুসলিম হোস্টেলের পুকুরে (জকি স্মৃতির প্রাইমারি স্কুলের সামনে) গোসল করার সময় জানান যে, ঢাকা থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চলে এসেছে। খবর পেয়ে দ্রুত আমাদের তখনকার আবাসস্থান মুসলিম হোস্টেলে ফিরে গিয়ে উপস্থিত হাবিবউল্লাহ ও শহীদুল্লাহ বাচ্চুকে এ সংবাদ জানাই।

শহীদুল্লাহ বাচ্চু তখনই রিকশায় চড়ে শিমুলতলীতে, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্লান্ট ও সমরাস্ত্র কারখানায় শ্রমিকদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জয়দেবপুরে চলে আসার খবর দেওয়া হলে এক ঘণ্টার মধ্যে মাঠেই হাজার শ্রমিক জনতা চারিদিক থেকে লাঠিসোঁটা, দা, কাতরা (বল্লম), ছেনি, দোনালা বন্দুকসহ জয়দেবপুর উপস্থিত হয়। সেদিন জয়দেবপুর হাটের দিন ছিলো। জয়দেবপুর রেল গেইটে মালগাড়ির বগি, রেলের অকেজো রেললাইন, স্লিপারসহ বড় বড় গাছের গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি যে যেভাবে পেরেছে তা দিয়ে এক বিশাল ব্যারিকেড দেওয়া হয়। 

জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরও ৫টি ব্যারিকেড দেওয়া হয় যাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ফেরত যেতে না পারে। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে, এম, শফিউল্লাহ (পরবর্তীকালে সেনাপ্রধান)। আমরা যখন ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম তখন টাঙ্গাইল থেকে রেশন নিয়ে একটি কনভয় জয়দেবপুর আসছিল। সে রেশনের গাড়িকে জনতা আটকে দেয়। সে কনভয়ে থাকা ৫ জন সৈন্যের চাইনিজ রাইফেল তাদের নিকট থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। 

এ দিকে রেল গেইটের ব্যারিকেড সরানোর জন্য ২য় ইস্ট বেঙ্গলের রেজিমেন্টকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব আদেশ দেয়। কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে দিয়ে পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্যদের অবস্থান নিয়ে মেজর শফিউল্লাহকে জনতার উপর গুলিবর্ষণের আদেশ দেয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা আমাদের (জনতার) উপর গুলি না করে আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ে সামনে আসতে থাকলে আমরা বর্তমান গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের উপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চাইনিজ রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ শুরু করি।

পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা, আহত হন চতরের সন্তোষ, ডা. ইউসুফসহ শত শত বীর জনতা। পাক বাহিনী কার্ফ্যু জারি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করলে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। আমরা পিছু হটলে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে ব্যারিকেড পরিষ্কার করে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার  প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। এ সময় নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাঞ্জাবি সৈন্যকে পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করে। আমরা সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নিই। কিন্তু পেছনে আরেক পাঞ্জাবি সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করে, হুরমত সেখানেই শাহাদাৎ বরণ করেন। বর্তমানে সেই স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।’

এদিন থেকেই শ্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ সন্ধ্যায় জয়দেবপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্যআইন জারি করা হয়।

এদিকে একদিন বিরতির পর সকালে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেড়ঘন্টার এই বৈঠক শেষে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি সব সময়েই ভালো আশা করি তবে খারাপের জন্যেও তৈরী থাকি।’

এদিন সন্ধ্যায় জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যারা বুলেট ও শক্তি দিয়ে গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করবেন বলে ভেবেছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, তারা শক্তি প্রয়োগে ভয় পায়।’

১৯ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুইঘন্টা স্থায়ী এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ.আর কর্নেলিয়াস, জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন।

ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অহেতুক ঢাকায় এসে সময় নষ্ট করছেন। ইয়াহিয়া খানের বোঝা উচিত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মনে রাখা উচিত যে, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। সুতরাং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকার তার নেই।

করাচিতে জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্যসহ সংখ্যালঘিষ্ঠ দলগুলোর পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ভূট্টো বিরোধী একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে একটি গণআন্দোলন শুরুর লক্ষ্যে তার দলের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা ঘোষণা করে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ক্ষমতার ব্যাপারে পিপলস পার্টিকে হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে আমি চুপ করে বসে থাকবো না। 

তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখেছেন, এবার আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের শক্তি দেখতে পাবেন।

এদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) নেতা মিয়া মমতাজ দৌতলতানা এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দুই নেতা মওলানা মুফতি মাহমুদ ও সরদার শওকত হায়াত খান ঢাকা এসে পৌঁছান।

১৯ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ভবন ও বাসভবনে অন্যান্য দিনের মতো কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের কুজকাওয়াজ ও অস্ত্রচালন প্রশিক্ষণ চলে।

[সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক-এর লেখার কিয়দংশ]

এডিবি/