ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১৪তম দিন:

দেশ চালাতে বঙ্গবন্ধুর ৩৫ নির্দেশনা, ‘পূর্ব পাকিস্তান’ কার্যত ‘বাংলাদেশ’


১৪ মার্চ ১৯৭১। সামরিক আইন লঙ্ঘন করে বাঙালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসহযোগের আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গশগ্রহণে এগিয়ে চলতে থাকে। বলতে গেলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ কার্যত তখন ‘বাংলাদেশ’। অফিস আদালত, বাড়ি, গাড়ি, দোকানপাট সব জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। পাকিস্তান রয়ে গেছে শুধু কাগজে-কলমে।

আগের দিন ১৩ মার্চ জারিকৃত সামরিক বিধি নং ১১৫ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানালেও এদিন শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমরা প্রত্যেকে মরণ বরণ করতে প্রস্তুত। … আমি জনগণকে যে কোনো ত্যাগের জন্যে এবং সম্ভাব্য সব কিছু নিয়ে সে কোনো শক্তির মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানাই।”

এদিন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। কিভাবে দেশের প্রশাসন চলবে এজন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ৩৫ দফা নির্দেশ জারি করা হয়।

১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচির শেষদিন ছিল। জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর চারদফা পূর্বশর্ত মেনে নেওয়ার দাবিতে ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী সংগঠন এবং যুব মহিলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারি ফেডারেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের সামনে সমাবেশ শেষে মিছিলসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাঁর হাতে একটি আবেদনপত্র দেওয়া হয়। তাতে নেতারা যে কোনো নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান।

১১৫নং সামরিক নির্দেশের প্রতিবাদে দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারিরা নগরীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে তারা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে বর্তমান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এদিন স্বাধীনতাকামী মানুষ বেশ কিছু মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে যান।

এদিন সকালে ঢাকায় ন্যাপ (ওয়ালী) প্রধান ওয়ালী খানের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ধানমন্ডি ৩২ এ মুজিবের বাসভবনে রুদ্ধদ্বার প্রায় দেড় ঘন্টার এ আলোচনাকালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামানসহ কয়েকজন আওয়ামী নেতা ও ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু অপেক্ষমাণ দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে তার সাথে আলোচনা করতে চাইলে তিনি যোগ দিতে প্রস্তুত। তবে আলোচনা তাদের দুজনের মধ্যেই হবে। এরমধ্যে কোনো তৃতীয়পক্ষ আলোচনায় অংশ নিতে পারবে না। আমরা কোনদিন অত্যাচার করার পক্ষপাতি নই কিন্তু আমাদের যদি কেউ অত্যাচার আমরা তাকে ছেড়ে দেবো না।” 

তিনি বলেন, স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে জীবন-যাপনের জন্যই আমাদের সংগ্রাম।

বৈঠক শেষে ওয়ালী খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমি পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি এবং ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসার জন্য আমরা আগ্রহী। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তারিখে যে ৪ দফা ঘোষণা দিয়েছেন আমরা তা সমর্থন করি। আমরা চাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কালবিলম্ব না করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক।”

এদিন বরিশালে আয়োজিত এক জনসভায় বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর প্রতি অস্থায়ী সরকার গঠনের আহ্বান জানান।

আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিটেজ হরাইজন’ এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরে পরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্তের দাবি জানান।

ছাত্র ইউনিয়ন এদিন আবারও মশাল মিছিল বের করে।

সংবাদপত্রগুলো বাংলায় “আর সময় নাই” এবং ইংরেজিতে “Time is running out” শিরোনামে যৌথ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ শহরে মিছিল বের করে। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের এই মিছিল জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে চট্টগ্রাম শহর। বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের চকবাজারের উর্দুগলিতে মিছিলে হানা দেয় বিহারী ও জামাতীরা। এতে সাতজন বাঙালি গুরুতর আহত হয়। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে নেওয়ার পথে দুজন মারা যায়। রাতে উত্তেজিত মুক্তিকামী মানুষ উর্দুগলিতে আক্রমণ করে। এ সময় বিহারী-জামাতিদের সাথে বাঙালীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

করাচিতে নিশাত পার্কে পিপলস পার্টির উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় এদিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপিপি-কে অর্থাৎ দুই পাকিস্তানে দুই দলকে ক্ষমতা দেওয়ার ফর্মুলা দেন এবং এজন্য বঙ্গবন্ধুকে আলোচনা করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ছয়দফার মাধ্যমে আওয়া্মী লীগ প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীনতা দাবি করছে যা পাকিস্তানের জনগন চায় না। মুসলিম লীগের আব্দুল কাইয়ুম ছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এই হঠকারী সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন।

অসহযোগ আন্দোলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিমা শিল্পপতিরা বঙ্গবন্ধুর চারদফা মেনে নেওয়ার জন্য সামরিক সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন।

এদিন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তার 'হেলালে ইমতিয়াজ' খেতাব বর্জন করেন। তিনি বলেন ”জনগন যেভাবে গনতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে আমি খেতাব বর্জন করেছি।”

এদিন বিকেলে জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগের ঢাকা ও আঞ্চলিক শাখাসমূহের নেতাদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জেলা ও থানা পর্যায়ের সংগ্রাম কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয় যেন তারা নিজেদের এলাকায় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং ট্রেনিং নেওয়া শুরু করে।

সন্ধ্যায় লালবাগ এলাকায় ছাত্রলীগ জনসভা করে সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শেখ শহীদুল ইসলাম বক্তৃতা করেন।

এদিন বাংলা অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গণে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আহমদ শরীফ স্যার সভাপতিত্ব করেন। বক্তৃতা দেন রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, রাবেয়া খাতুন, আহমদ ছফা ও আরও কয়েকজন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে লেখকদের সংগ্রামী ভূমিকা সম্পর্কে উদ্দীপনাময় ছিল সেই বক্তৃতা।

কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সদস্য - সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রহমান, বদরুদ্দিন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বোকনুজ্জামান খান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, আবদুল গনি হাজারীসহ আরও অনেকে। সভা শেষে মিছিল বের হয়। মিছিলে যোগ দেন জাহানারা ইমাম।

অন্যদিকে বেতার ও টেলিভিশনে এদিন মিলিটারি মোতায়েন করা হয়েছিলো। এর প্রতিবাদে মিছিল করে শিল্পী সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা।

এদিন দেশের প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করার ঘোষণা দেন ঝিনাইদহের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা।

এদিন বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী মন্টেসেলো ভিক্টরি নামের আর একটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ওসান এন্ডুরাস নামের সমরাস্ত্রবাহী আর একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০নং জেটিতে নোঙর করে বন্দর শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে ৯ মার্চ ১৬নং জেটিতে সমরাস্ত্রবাহী অপর জাহাজ ‘সোয়াত-এর সমরাস্ত্র খালাসের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে।

[সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ]

এডিবি/