ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১২তম দিন:

পুরো বাংলা চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, শাপলাকে জাতীয় ফুল ঘোষণা


১২ মার্চ ১৯৭১। অন্যদিনের মতো এই দিনটিতেও বাঙ্গালি জাতি পার করছিল এক উত্তাল সময়। এদিন শাপলা ফুলকে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১২ মার্চ সারাদেশ ছিল আন্দোলন সংগ্রামমুখর। প্রতিদিনই ছোট বড় অসংখ্য মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে আসতে থাকে।বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বত্র অসহযোগ চলমান। সরকারি আধাসরকারি কর্মচারিদের কর্মস্থল বর্জন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা, সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানোর মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থা বলে কিছু ছিলো না। শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া পুরো বাংলার সবকিছু পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।

এদিন প্রায় অর্ধশত চারু ও কারুশিল্পীর উপস্থিতিতে পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসানের আহ্বানে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আয়োজিত সভায় মুর্তজা বশির ও কাইয়ুম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে  ‘চারুশিল্প সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এ সভায় শাপলা ফুলকে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঘোষণা শেষে মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন আরও বেশি উৎসাহী করে তুলতে তারা প্রতিবাদী পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন বিলি করেন।

চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকাল সিনেমাহল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনকে জোরদার করতে, আরও সঙ্ঘবদ্ধ করতে রাজপথে নেমে আসে। পাকিস্তানবিরোধী স্লোগানে রাজপথকে উত্তাল করে তোলে।

জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ জহিরুদ্দিন তার পাকিস্তানি খেতাব বর্জন করেন।

প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্য পাঠানো খাদ্যবোঝাই মার্কিন জাহাজের গতি বদলে করাচি পাঠানোয় উৎকন্ঠা ও তীব্র নিন্দা জানান।

প্রতিদিনের মতো এদিনও ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন শহরে মিছিল-সমাবেশ করে।

ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপপ্রধান আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে লাথি মেরে শেখ মুজিব যদি বাঙ্গালীর স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলনকে সঠিক ভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে তাহলে তিনি ইতিহাসের কালজয়ী বীর হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন”।

১২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বাঙালি আমলারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারা আন্দোলনে অর্থের যোগান দিতে তাদের একদিনের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দেন।

বগুড়া জেলখানা ভেঙ্গে ২৭ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। কারারক্ষীদের গুলিতে ১ জন কয়েদী নিহত ও ১৫ জন আহত হয়।

বাঙালীর উপর বিহারীদের হামলা ও সেনাবাহিনীর একতরফাভাবে বিহারীদের পক্ষ অবলম্বনের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম শহরে মিছিল বের হয়। চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের জরুরী সভা ডাকা হয়। সভায়, সবাইকে সংযম রক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়। পরে এদিন বিকেলে চট্টগ্রামে শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের নেতৃত্বে শান্তি মিছিল বের হয়।

গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দোষ করা হলো লাহোরে কিন্তু বুলেট বর্ষিত হল ঢাকায়।

তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণ সমান অধিকার নিয়ে থাকতে চায়, পশ্চিমাঞ্চলের দাস হিসেবে নয়। পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে। আর তা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।

লাহোরে ন্যাপের মহাসচিব সি.আর. আসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, দেশের বর্তমান সঙ্কটের জন্য একচেটিয়া পুঁজিপতি ও আমলারাই দায়ী। ভূট্টোও এ ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। ভূট্টোর হুমকিপূর্ণ মনোভাব ও ক্ষমতা লিপ্সাই রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে।

এদিন পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব বর্জন করেন জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন।

রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারি ঘোষণায় ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের নির্ধারিত সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।

এদিন আওয়ামী লীগ প্রদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আদেশ দেয়। পূর্ব পকিস্তানে কর্মরত বাঙালি সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসার, সরকারি এবং আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা এই আন্দোলনে সমর্থন দেন।

পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শুধু সংগ্রাম, মিছিল-সমাবেশই নয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারাদেশেই যুবক সমাজকে একত্রিত করে চলতে থাকে গোপনে গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। গোপনে অস্ত্র-গোলাবারুদও যোগাড় চলতে থাকে নানা মাধ্যম থেকে। আর এই প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র যোগানে সাহায্য করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে থাকা কিছু বাঙালি অফিসার-জওয়ান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা-সৈনিকরা।

[তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ, ১০ মার্চ ১৯৭১]

এডিবি/