ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১৭তম দিন:

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার দ্বিতীয় দফা বৈঠক, সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান


১৭ মার্চ, ১৯৭১। এদিনও অসহযোগ আন্দোলনের সভা, সমাবেশ, মিছিলে উত্তাল ছিল ঢাকাসহ সারাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে নির্দেশ দিচ্ছেন, বাংলার সব মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন। 

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। শেখ মুজিব কালো পতাকা শোভিত সাদা গাড়িতে চড়ে সকাল ১০টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন এবং ১১টা ৬ মিনিটে বের হয়ে আসেন। এদিন বৈঠক প্রায় এক ঘন্টা চলে। প্রেসিডেন্ট ভবনে এই বৈঠক শুরু হয় কড়া সামরিক প্রহরার মধ্যে।

আলোচনা শেষে অপেক্ষমাণ দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দেখুন আমার বলার কিছুই নাই। আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আমরা আবার আলোচনায় মিলিত হবো। পরবর্তী দফা আলোচনা কখন অনুষ্ঠিত হবে তার সময় এখনো নির্ধারণ হয় নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদে সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে এবং লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।’

এরপর শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরে যান। সেখানে পৌঁছালে দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের অনুরোধে তিনি তাদের সাথে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। জন্মদিনে তাঁর কামনা কি, এক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু জন্মদিনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন - “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কামনা জনগণের সার্বিক মুক্তি।” 

সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি আমার জন্মদিন পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই কী বা মৃত্যুদিনই বা কী? আমার আবার জন্মদিন কী? আমার জীবন নিবেদিত জনগণের জন্য।”

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরও সৈন্য আনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানেন কি-না, বিদেশি এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে তার সব খবরই আমি রাখি।

পরে বঙ্গবন্ধু দলীয় হাই কমান্ডের সাথে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনায় দলীয় হাই কমান্ডকে প্রেসিডেন্টের সাথে তার আলোচনা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং সেই আলোকে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেন।

মুজিব-ইয়াহিয়ার পরবর্তী বৈঠকের কোনো সময় নির্ধারণ না হওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ভিড় জমান। ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি কেবল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যে জনগণ, তাদের পরিচালন কেন্দ্রেই পরিণত হয়নি, সেই সঙ্গে হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের মিলনক্ষেত্রও। 

এদিও সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এলে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার উঠে এসে শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।

ভাষণে তিনি বলেন, তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোল। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হানো। চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকাে। মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও ওপরে তুলে ধরো। সাত কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।

এদিকে এদিন ইয়াহিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান থেকে ঢাকা আসা সাবেক কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কর্নেলিয়াস ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি মেজর জেনারেল ওমর প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের চিফ স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদার সাথে এক আলোচনায় মিলিত হন।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান খান আব্দুল ওয়ালী খান ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে একঘন্টাব্যাপী বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের জন্য জাতীয় পরিষদই সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত স্থান। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ৪ দফা দাবি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে ন্যাপ প্রধান বলেন, এ ব্যাপারে পূর্বেই আমি আমার অভিমত ব্যক্ত করেছি।

ন্যাপ সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের পরিবর্তে ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস’ পালনের জন্য দলীয় কর্মী ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। 

বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখান থেকে আর পিছু হটা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উচিত হবে শেখ মুজিবর রহমানের দাবিগুলো মেনে নেওয়া।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালনের আহ্বান জানায়।

এদিন ‘খ’ জোনের সামরিক আইন প্রশাসক ২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় যে পরিস্থিতিতে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্যের জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয় তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশ জারি করেন।

ঘোষণায় আরও বলা হয়, প্রধান বিচারপতি তদন্ত কমিশনের প্রধানকে মনোনয়ন দেবেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিস এবং ইপিআর থেকে সদস্য নিয়ে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হবে।

এদিন সরকারি বেসরকারি ভবনে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস-আদালতে অনুপস্থিত থেকে সব শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত সংগ্রামের কর্মসূচি পালন করেন।

এদিন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন এম এন এ অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খান “তমঘা-ই-কায়েদে আজম” এবং কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন “তমঘা-ই-ইমতিয়াজ” খেতাব বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

সময় ও কালক্ষেপনের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ আসতে থাকে পূর্ব-পাকিস্তানে এবং পাকিস্তানি সামরিক সরকার পূর্ববাংলায় দমননীতি ও ব্যাপক গণহত্যার জন্য নীলনকশা আঁকতে থাকে।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ওয়ালী ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান এক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জোও উপস্থিত ছিলেন।

রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, আগামীকাল সকাল ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

এদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা এই দুই স্থানে নিরস্ত্র আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

রাতে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উসকানিমূলক আচরণ, তা যে কোনো মহলেরই হোক না কেনো, আমরা আর সহ্য করবো না। এর ফলাফলের দায়িত্ব উসকানিদাতাদেরই সম্পূর্ণ বহন করতে হবে।

এইদিনে বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘ইরনা এলিজাবেথ’ নামের একটি জাহাজের গতিপথ বদল করে চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সরেজমিন তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যায়।

১৭ মার্চ ঢাকায় বিমান বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শপথ নেন সর্বশক্তি ও সম্পদ নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের।

করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বলেন, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনো জবাব না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

[সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ]

এডিবি/