ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ২১তম দিন:

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর বৈঠক, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা


২২ মার্চ ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের একুশতম দিন। সকাল সাড়ে ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। বৈঠক চলে প্রায় ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার নির্ধারিত বৈঠক ছিল। সে অনুযায়ি আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে মি. ভুট্টো উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, ৪টি শর্ত পূরণ না হলে আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারি না।’

প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে নিজ বাসভবনে ফিরে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আন্দোলনে আছি এবং লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

আজকের আলোচনায় কতটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বহু সাংবাদিকের এ রকম প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু খানিকটা উচ্চকণ্ঠে বলেন, ‘আলোচনায় অগ্রগতি সাধিত না হলে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি কেন? ’

অপর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ইতোমধ্যে বাংলাদেশে গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

২২ মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন, তাতে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের উভয়াংশের নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতার ক্ষেত্র অধিকতর প্রসারিত করার সুবিধার্থে ২৫ মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো।’

এদিকে রাজধানী ঢাকায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানের তিনটি পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতৃবৃন্দ ওয়ালী খান, দৌলতানা এবং মুফতি মাহমুদ প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা এখনো বিশ্বাস করি যে, যে কোন রকম জাতীয় ইস্যুতে আলোচনার এবং মীমাংসার সর্বাপেক্ষা উত্তম স্থান হচ্ছে জাতীয় পরিষদ।’

এদিন ইয়াহিয়া খান মিয়া মমতাজ দৌলতানা, সরদার শওকত হায়াত খান, মওলানা মুফতি, খান আব্দুল ওয়ালী খান ও মীর গাউস বক্সের সাথেও আলোচনায় মিলিত হন।

প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে কড়া সামরিক পাহারায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফিরে দুপুরে ভুট্টো তার উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। পরে

ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি নেতারা সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যান এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনায় বসেন।

রাতে ভুট্টো হোটেল লাউঞ্জে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী লীগপ্রধান বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য একটি সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। তবে ওই ঐকমত্যের ভিত্তিতে যদি জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের আগেই সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় তবে তা কখনই পিপলস পার্টির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং ঘোষণাটি ‘আইনগত বৈধতাহীন’ হয়ে পড়বে। পিপলস পার্টির অনুমোদন ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারে না।’’

এদিকে এদিন আইন বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহি বলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা নেই।’

এদিন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে শিশুকিশোরদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে শিশুকিশোররা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে।

পল্টন ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকরা মেজর জেনারেল এম আই মজিদের সভাপতিত্বে সমাবেশ করেন। সমাবেশে কর্নেল ওসমানী, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট খলিলুল্লাহ, কমোডর জয়নুল আবেদিন, আশ্রাফ মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আহমদ প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে তাতে প্রাক্তন সৈনিকরা আর প্রাক্তন হিসেবে বসে থাকতে পারে না। আমাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মূল্যবান সম্পদ। আমরা শেখ মুজিবের নির্দেশ পালনে প্রস্তুত। সমাবেশ শেষে এক কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠিত হয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন রাতে ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’ উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে বলেন, ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের পথে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকি তাহলে কোনো কিছুই আমরা হারাবো না।’

আজ পত্রিকায় পাঠানো এক বিশেষ বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের বৈধতার কারণে বিজয় এখন থেকে আমাদেরই।’ বাংলাদেশের সকল দৈনিক পত্রিকার জন্য পাঠানো এ বাণীটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের মুক্তি’। বাণীতে সাত কোটি বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির জন্য চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বেয়নেট এবং বন্দুক দ্বারা বাংলাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করা যাবে না, কারণ তারা আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে যে কোন প্রকার আত্মত্যাগে আমরা প্রস্তুত। যে কোনেআ আক্রমণ প্রতিহত করতে বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।’

এদিন সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রচারিত বাংলাদেশের পতাকার প্রতিকৃতি প্রকাশিত হয় এবং ২৩ মার্চ এই পতাকা উত্তোলন ও পাকিস্তানের পতাকা বর্জনের আহ্বান জানানো হয়।

চট্টগ্রামে পতাকার প্রচার ও তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন পতাকা বিক্রি করে। এ সময় চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ওয়ালিউল ইসলাম পাঁচলাইশে মেজর জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তার কাছে একটি পতাকা বিক্রি করে।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কর্মচারীরা দ্বিতীয় দিনেরমতো বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও কালো ব্যাজ ধারণ করে ভুট্টো ও তার সাথীদের সেবা দেন।

লেখক সংগ্রাম শিবির বাংলা অ্যাকাডেমিতে ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদী কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করেন। এতে আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবির, শাহনুর খান, আখতার হোসেন, রফিক নওশাদ, মাহবুব সাদিক, সালেহ আহম্মদ, দাউদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, মেহেরুন্নেসা প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।

আজও স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষুব্ধ মানুষের সভা, শোভাযাত্রা আর স্লোগানে ঢাকার আকাশ-বাতাস মুখরিত ছিল। জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হাজার হাজার মানুষ শেখ মুজিবের বাসভবনের দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। বাসভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার বক্তৃতা দেন। সংগ্রামী জনতার ‘জয় বাংলা’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ শ্লোগান চলতে থাকে।বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একের পর এক শান্তিপূর্ণ মিছিলের স্রোত আসতে থাকে। স্লোগানরত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগ ও আমাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত করেছে। সুতরাং শাসন করার বৈধ অধিকার কেবল আমারই আছে। বুলেট এবং বেয়নেটের মাধ্যমে যতো ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন সমগ্র বাংলাদেশ আজ জাগ্রত, বাঙালি জাতি আজ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল ও ঐক্যবদ্ধ। সুতরাং জয় আমাদের সুনিশ্চিত। যদি তারা দ্রুত আমাদের ৪ দফা দাবি মেনে নেয় তাহলে এখনও পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে বসবাস সম্ভব।’ 

এদিন বিদেশি টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করার নৈতিক বৈধতা কেবলমাত্র আমারই রয়েছে, অন্য কারও নয়।’

[সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ]

এডিবি/