ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ২২তম দিন:

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার ৫ম দফা বৈঠক, ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান


২১ মার্চ ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের বিশতম দিন। সকালে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে পঞ্চম দফা বৈঠকে মিলিত হন। ৭০ মিনিটের এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ।

বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে রাগত স্বরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।” সাংবাদিকরা আলোচনার ফলাফল জানতে নেতাকে চাপাচাপি করতে থাকলে তিনি আর কিছু বলতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে স্বীয় বাসভবনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বাসভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাগণের সাথে ৪টি শর্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওনারা আমার কাছে একটা কথাই বার বার বলছেন যে, আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসুক। আমি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছি, এতো কিছু হওয়ার পরে আমার কাছে ওই ৪ দফা ছাড়া আর অন্য কোন কথা নাই। আমি আমার জনগণের কাছে যা বলেছি, বার বার তাই আমি আপনাদের কাছেও বলছি। এ ভিন্ন আমার অন্য কোন কথা নাই। আলোচনা সফল করতে হলে এখন প্রেসিডেন্টকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” [তোফায়েল আহমেদ]

ইয়াহিয়া খানের সাথে পঞ্চম দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পূর্বে তাঁর নিজ বাসভবনে বিশিষ্ট আইনজীবী এ.কে.ব্রোহির সাথে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় মিলিত হন।

এদিন সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তাঁর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। মিঃ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুকে এমনকিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তৎক্ষণাৎ সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “আমি আমার জনগণকে পাকিস্তানের শেয়ালদের হাত থেকে মুক্ত করে আমেরিকান বাঘদের হাতে তুলে দিতে পারি না।” [তোফায়েল আহমেদ]

এদিনও মুক্তিকামী হাজার হাজার জনতার দৃপ্ত পদচারণায় ঢাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত মিছিল ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান তুলে কেন্দ্রীয শহীদ মিনার অভিমুখে এগিয়ে চলে। সেখানে মুক্তি অর্জনের শপথ নিয়ে মিছিল যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আন্দোলন শিথিল হবে না’।

এদিন শেখ মুজিব ভাসানীর কাছে বিশেষ দূত মারফত সংবাদ পাঠান।

বিকেলে চট্টগ্রাম ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পোলো গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় বলেন, আলোচনায় ফল হবে না। এদেশের হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে চাপরাশি পর্যন্ত যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে মানে না, তখন শাসন ক্ষমতা শেখ মুজিবের হাতেই দিতে হবে।

২১ মার্চ কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনের পরে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসেন। ভুট্টোর সঙ্গে ছিলেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল জে. এ রহিম মিয়া, মাহমুদ আলী কাসুরী, গোলাম মোস্তফা জাতো, মমতাজ আলী ভুট্টোসহ মোট ১২ জন উপদেষ্টা। ভুট্টোর আগমন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে সেনা মোতায়েন করা হয়। সাংবাদিকদের বিমানবন্দরে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। ভুট্টোকে বিমানবন্দর থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে আসার সময় রাস্তার দু’পাশের পথচারী ভুট্টো-বিরোধী শ্লোগান দেয়।

বিমানবন্দর এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ভুট্টো ও সফরসঙ্গীরা অস্বস্তিকর পরিস্থিতে পড়েন। সেই পরিস্থিতি নিয়ে দৈনিক আজাদ একটি রিপোর্ট করে। তাতে লিখা হয় - এমনকি হোটেলের লিফটও তাকে বহনে রাজি হয়নি। ভুট্টো লিফটে উঠতে গেলে হঠাৎ সেটি অচল হয়ে পড়ে। [সূত্র : বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস: ড. মোহাম্মদ হাননান]

সন্ধ্যায় পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো কড়া সেনা প্রহরায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। সেখানে ভুট্টো দু’ঘন্টারও বেশি সময় প্রেসিডেন্টের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন।

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরেই ভুট্টো তার উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। এর আগে হোটেল লাউঞ্জে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের ভুট্টো বলেন, এ মুহূর্তে আমি এটুকু বলতে পারি যে, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ভুট্টো সাংবাদিকদের আর কোন সময় না দিয়ে সরাসরি লিফটে চড়েন। সাংবাদিকরা তার সহগামী হতে চাইলে ভুট্টোর ব্যাক্তিগত প্রহরীরা অস্ত্র উঁচিয়ে বাধা দেয়।

এদিন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান জানায় (১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত ২৩ মার্চ উদযাপিত হতো পাকিস্তান দিবস বা লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবে)। নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ. স. ম আব্দুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এই চার নেতা প্রতিরোধ দিবস কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

১) ভোর ৬টায় সরকারি ও বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন।

২) ভোর সাড়ে ৬টায় প্রভাতফেরি ও শহীদের মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ।

৩) ৯টায় পল্টন ময়দানে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ।

৪) ১১টায় বায়তুল মোকাররমে ছাত্র জনসভা।

২১ মার্চ স্বাধিকারের দাবিতে নারায়ণগঞ্জে ছাত্রজনতা দুপুর ১ টায় দীর্ঘ জাহাজ মিছিল বের করে।

ভাসানী ন্যাপের পূর্বাঞ্চল শাখার সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া এক বিবৃতিতে জয়দেবপুরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে গণহত্যার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে জনগণের কাছে আহ্বান জানান।

১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জারিকৃত কারফিউ ৪২ ঘণ্টা অব্যাহত রাখার পর দুপুর ১২টায় ৬ ঘন্টার জন্য প্রত্যাহার করা হয়। পরে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুনরায় কারফিউ বলবৎ করা হয়।

এদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ২৩ মার্চ স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবসের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। মগবাজারে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক মহিলা সমাবেশে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের নিয়ে একটি প্যারা-মিলিটারি গঠনের আহ্বান জানানো হয়।

ন্যাপ (ভাসানী) সদরঘাট, বাহাদুরশাহ পার্ক, মৌলভীবাজার, চকবাজারসহ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পথসভা আয়োজন করে।

[সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ]

এডিবি/