ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ১৮তম দিন:

সামরিক প্রশাসকের তদন্ত কমিটি প্রত্যাখ্যান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন বঙ্গবন্ধু


১৮ মার্চ ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের সতেরোতম দিনে সরকারি বেসরকারি ভবনের ছাদে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস আদালতে অনুপস্থিতিসহ বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত সংগ্রামের কর্মসূচি চলতে থাকে।

আগেরদিন ‘খ’ জোনের সামরিক আইন প্রশাসক যে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন তা প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগ। সেইসঙ্গে কমিশনের কাজে কোনভাবে সহায়তা না করার জন্যে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদ এবং চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এম.এন.এ আবিদুর রেজা খানকে সদস্য করে বঙ্গবন্ধু একটি পাল্টা তদন্ত কমিশন গঠন করেন এবং তাঁদের সরজমিন তদন্তের জন্যে চট্টগ্রামে পাঠান।

১৮ মার্চ সামরিক কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিশন প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন -

'আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি যে দাবি জানিয়েছিলাম, ঘোষিত “তদন্ত কমিশন” সে দাবি পূরণ করতে পারবে না। সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশবলে এ তদন্ত কমিশন গঠন এবং সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের রির্পোট পেশ করার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা অত্যন্ত আপত্তিজনক। কারণ এর শর্তাবলী পূর্বাহ্নে বিবেচ্য প্রধান প্রধান মৌলিক বিষয়গুলো নস্যাৎ এবং পৃথককৃত ঘটনাবলী সম্পর্কে তদন্ত করার পথ রুদ্ধ করে দেবে।

এ তদন্ত কমিশনের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হলো - ‘২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত কি পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্যের জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল। সুতরাং মৌলিক বিষয়টি এভাবেই স্থির করে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তদন্তের বিষয় ছিল বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহয্যের জন্যে জন্যে নিয়োগ না করে সেনাবাহিনীর নিয়োগ ও শক্তি প্রয়োগ রাজনৈতিক স্বার্থেই করা হয়েছিল কিনা? তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকৃতপক্ষে যেসব জোর-জুলুম করা হয়েছে এবং হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে ‘কমিশন’-এর সে ব্যাপারে তদন্তের পথ রূদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে এমন কি হতাহতের সংখ্যা কতো এবং কোন পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র জনগণের প্রতি গুলিবর্ষণ করা হয়েছে তারও তদন্ত করা যাবে না।

সুতরাং ‘কমিশন’ কোনো সত্যিকার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে না। ফলে, সত্যি ঘটনার মূল উদঘাটনের ব্যাপারে তদন্ত হবে না এবং এটা জনগণকে বিভ্রান্ত করার একটা ফন্দিমাত্র।

সুতরাং আমরা এরূপ ‘কমিশন’ অনুমোদন করতে পারি না। বাংলদেশের জনগণ কোনক্রমেই এরূপ ‘কমিশনের’ সাথে সহযোগিতা করতে পারে না। এ ‘কমিশনে’ কারো কোন সদস্য মনোনীত কিংবা কারো এর সদস্য হিসেবে কাজ করা উচিত নয়।

জনগণের পক্ষ থেকে আমরা ৭ মার্চ ৪-দফা শর্ত উপস্থিত করেছি। তার মধ্যে একটি দাবি ছিল যথাযথ শর্ত সম্বলিত ন্যায্য, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। সেগুলোর মধ্যে কেবল নামমাত্র এবং খণ্ড খণ্ড দাবি গ্রহণ এবং যেভাবে এ দাবি গ্রহণ করা হয়েছে তার ফলে আমরা যে চরম সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছি, সে সমস্যার সমাধান হবে না।' (সূত্র: পূর্বদেশ, ১৯ মার্চ ১৯৭১)

ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধু বাসভবনের সামনে অবস্থান করে শ্লোগান দিতে থাকে, গোলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ (ওয়ালী) প্রধান ওয়ালী খান ঘন্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। তাদের সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জোও উপস্থিত ছিলেন।

রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, পরদিন ১৯ মার্চ সকাল ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

ঢাকায় বিমানবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শপথ নেন সর্বশক্তি ও সম্পদ নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারের।

করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি তা প্রত্যাখান করেছেন। এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বলেন, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার কোনো জবাব না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চিন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালি হত্যার অপচেষ্টা বন্ধ করার আবেদন জানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা অপর এক বিবৃতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে আসন্ন গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানান।

এদিন প্রচুর সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আগত শপথদীপ্ত ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, কর্মচারী, শ্রমিক, কৃষক, নার্স, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের সংগঠনগুলো অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপন করে নেতার আশীর্বাদ কামনা করেন।

[সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ]

এডিবি/